দেশের প্রাণকেন্দ্র রাজধানী ঢাকায় প্রায় দুই কোটি মানুষের বসবাস। আর এত বিশাল সংখ্যক মানুষের নিরাপত্তার দায়িত্ব ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি)।
আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় ২৪ ঘণ্টা কাজ করে যাচ্ছে তারা। রাজধানীর সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা মোটামুটি নিশ্চিত করতে পারলেও বন্ধ হয়নি ‘ঘুষ’। ডিএমপির বিভিন্ন থানায় এখনো মামলা করতে ও আসামি ছাড়িয়ে নিতে গুনতে হয় ‘ঘুষ’ এমনটাই অভিযোগ সাধারণ মানুষের।
এই ঘুষের লেনদেন বন্ধ করতে না পারলে কোনোভাবেই স্মার্ট ডিএমপি গড়ে তোলা সম্ভব না বলে মন্তব্য অপরাধ বিশেষজ্ঞদের। ডিএমপি কমিশনার বলছেন, থানাকে মানুষের আশ্রয়স্থল বানাতে পারলে সব করা সম্ভব। তাই সংশোধনের সুযোগের পাশাপাশি সাজাও নিশ্চিত করা হচ্ছে। জবাবদিহিতার আওতায় আনা হচ্ছে সবাইকে।
৪৭ বছর আগে ১৯৯৬ সালের ১ ফেব্রুয়ারি ‘শান্তি শপথে বলীয়ান’ রাজধানীতে ১২ থানা ও মাত্র সাড়ে ৬ হাজার জনবল নিয়ে গঠিত হয় ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)। ৪৮ বছরে পদার্পণ করেছে ডিএমপি। বর্তমানে রাজধানীতে আর ১২টি থানা নেই। এখন থানার সংখ্যা ৫০টি এতে কাজ করেন ৩৪ হাজরের বেশি সদস্য। ডিএমপিতে কাজের পরিধি অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। বাংলাদেশ পুলিশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ ডিএমপি। তাই এটিকে সবচেয়ে গুরুত্ব দিয়ে সর্বোচ্চ আধুনিক করা হয়েছে।
প্রতিষ্ঠার ৪৮ বছরে এসে দেখা যায় ডিএমপির পরিবর্তন সবচেয়ে বেশি। এতটাই আধুনিক হয়েছে যা দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের মেট্রোপলিটন কেন্দ্রীক পুলিশের তুলনায় কম নয়। এখানে লোকসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছ অনেক বেশি। আধুনিকতার ছোয়া এসেছে মানুষের জীবনে। কিন্তু এসবের পাশাপাশি অপরাধ কার্যক্রমও বৃদ্ধি পেয়েছে। এই অপরাধ দমন ও প্রতিরোধে বিভিন্ন সময় তৈরি করা হয়েছে নতুন নতুন ইউনিট।
ঢাকা মহানগর পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, ডিএমপিকে একটি যুগোপযোগী, দক্ষ ও জনবান্ধব বাহিনীতে উন্নীত করার লক্ষ্যে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। মাদক, জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় ডিএমপির সাফল্য বিশ্বজুড়ে প্রশংসিত হয়েছে। জনসম্পৃক্ততা বৃদ্ধির লক্ষ্যে কমিউনিটি পুলিশিং, বিট পুলিশিং ও উঠান বৈঠকের মতো সময়োপযোগী ও কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।
তথ্য অনুযায়ী, ঢাকা মহানগর পুলিশের বিভাগ আছে ৫৭টি। রাজধানীতে থানা আছে ৫০টি। ডিএমপিতে আছে ৩৪ হাজার পুলিশ সদস্য। যার মধ্যে একজন কমিশনার, ৬ জন অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার, ১২ জন যুগ্ম পুলিশ কমিশনার, ৫৭ জন উপ-পুলিশ কমিশনার রয়েছে।
উন্নত প্রযুক্তির প্রয়োগ ঘটিয়ে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের মাধ্যমে ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত স্মার্ট বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় প্রযুক্তিনির্ভর দক্ষ টিম ডিএমপি হবে ঢাকাবাসীর গৌরবময় সেবা প্রদানের ‘স্মার্ট ডিএমপি’। এই মুহূর্তে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, মেটাভার্স, ওয়েব-৩ প্রযুক্তি, ভার্চুয়াল রিয়েলিটি, কোয়ান্টাম প্রযুক্তি ব্যবহারের সক্ষমতা অর্জন করেছে ডিএমপি।
ডিএমপিতে জাতীয় পরিচয়পত্রের সঙ্গে যুক্ত ডায়নামিক রেসপন্স ইন্টিলিজেন্ট মনিটরিং সিস্টেম (ডিআরআইএমএস) ও সিটিজেন ইনফরমেশন ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম (সিআইএমএস), সাসপেক্ট আইডেনটিফিকেশন অ্যান্ড ভেরিফিকেশন সিস্টেম (এসআইভিএস), ফেস ম্যাচিং, সিআইএ ল্যাব, আইপি ট্র্যাকার, সাইবার বুলিং অ্যান্ড ক্রাইম মনিটরিং সিস্টেম, ওয়ান স্টপ সার্ভিস, অত্যাধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর সিসিটিভি মনিটরিং সিস্টেম, হ্যালো সিটি অ্যাপ, সিডিএমএস ও পিআইএমএস চালু করা হয়েছে।
ডিএমপির সবচেয়ে সফল কার্যক্রম জঙ্গি ও সাইবার অপরাধ। এর পাশাপাশি মাদক, শিশু ও নারি নির্যাতন, সন্ত্রাসী কার্যক্রমসহ নানা অপরাধা দমনে কাজ করে ডিএমপি।
ডিএমপির দেয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালে ডিএমপি সাইবার অপরাধ সংক্রান্ত ১৭১টি মামলায় ১১৫ জন, ৩৫টি মামলায় ৮৭ জন জঙ্গি, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে ১৬ হাজার ৩৫টি মামলায় ২১ হাজার ৯৮০ জন, অস্ত্র ও গোলাবারুদ সংক্রান্ত মামলায় ৪১০ জন, নারী ও শিশু নির্যাতন সংক্রান্ত ২ হাজার ১০টি মামলায় ১ হাজার ৭০৯ জন, ১৬৯টি চোরাচালান মামলায় শতাধিক আসামিকে গ্রেফতার করেছে।
আরো জানা যায়, ৬৫টি আগ্নেয়াস্ত্র, ২৫২ রাউন্ড গুলি, ৪ হাজার ২৬৮ কেজি বিস্ফোরকদ্রব্য, ৫৫ কেজি হেরোইন, ৪০ লাখ ৯৩ হাজার ৬০০ পিস ইয়াবা, ৫৬ হাজার ৭৯৪ ক্যান বিয়ার, ৫১ হাজার ২৫৭ বোতল ফেনসিডিল, ৮ হাজার ২৫ বোতল বিদেশি মদসহ অন্যান্য নতুন নতুন ভয়ংকর মাদকদ্রব্যসহ ১৩ হাজার ২৯১ দশমিক ৫ কেজি গাঁজা ২০২২ সালে উদ্ধার করেছে।
আইন অমান্যকারী যানবাহন ও চালকদের বিরুদ্ধে ২০২২ সালে ই-প্রসিকিউশন দায়ের হয়েছে দুই লাখ ৬৪ হাজার। এই সময় জরিমানা করা হয়েছে ৫৫ কোটি টাকা। সড়ক পরিবহন আইন. ২০১৮ অনুযায়ী এই কার্যক্রম চালায় ডিএমপি।
এর পাশাপাশি নারী ও শিশুদের জন্য নির্ভরতার প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে ডিএমপির উইমেন সাপোর্ট অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন ডিভিশন। ২০২২ সালে ২ হাজার ৩৭৭ জন নারী ও শিশুকে সেবা দিয়েছে তারা। এই ঢাকাকে নিরাপদ রাখতে প্রতি রাতে ৮
হাজার পুলিশ নিয়োজিত থাকে। রাজধানীতে দেড় হাজারের বেশি ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা বসিয়ে নিরাপত্তা মনিটরিং করছে। মেট্রোরেলের জন্য আলাদা পুলিশ গঠন না হওয়ায় ঢাকা মহানগর পুলিশ আপাতত সব কিছুই দেখভাল করছে।
এত সবকিছুর পরও ডিএমপির সদস্যদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় ঘুষ নেয়ার অভিযোগ উঠেছে। বিভিন্ন সময় মানুষের কাছ থেকে টাকা নিয়ে মামলার মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। এমনকি টাকা না পাওয়ার কারণে হয়রানিমূলক
মামালাও দেয়া হয় বলে অনেক সময় অভিযোগ রয়েছে। থানায় এখনো মামলা বা সেবা নিতে গেলে পুলিশ সদস্যরা টাকা চায় বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। তবে শুধু অভিযোগই না, ভালো কাজের সুনামও রয়েছে পুলিশের। চুরি, ছিনতাই, হত্যাকাণ্ড, জঙ্গিদমনসহ নানান অপরাধে জড়িতদের আইনের আওতায় এনে রাজধানীর মানুষের আস্থাও কুঁড়িয়েছেন তারা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক বলেন, মানুষের সর্বশেষ ভরসা পুলিশ। রাজধানীতে মানুষ শান্তিতে বসবাস করছে পুলিশের জন্যই। ঢাকা মহানগর পুলিশের অনেকে করোনার সময় মানুষের জন্য সড়কে
থেকে মারাও গেছেন। মানুষ যখন ঘরে ঘুমায় তখন পুলিশ আমাদের পাহাড়া দেয়। কিন্তু বিপরীত দিকও আছে। পুলিশের কিছু সদস্যের কারণে সমালোচিত হয় পুরো বাহিনী। স্মার্ট ডিএমপি বানাতে অবশ্যই ‘ঘুষ’ লেনদেন বন্ধ করতে হবে।
পেশাদারিত্বের অভাব রয়েছে পুলিশের কিছু সদস্যের মধ্যে। বিভিন্ন সময় পরিস্থিতির সঙ্গে ও রাজনীতির সঙ্গে আপোষ করতে হয়। এটা দূর করতে হবে। এটা করতে না পারলে মানুষের যে নিরাপত্তা ও আস্থার জায়গা অর্জন করতে পারবে না পুলিশ। আর শুধু পুলিশ ও ডিএমপি স্মার্ট হলেই হবে না। নাগরিকদেরও স্মার্ট হতে হবে।
৪৮তম প্রতিষ্ঠা দিবস উপলক্ষে ডিএমপি কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী চাইছেন স্মার্ট বাংলাদেশ। সেই সঙ্গে ডিএমপিকেও স্মার্ট ডিএমপিতে পরিণত করা হবে। সেজন্য আমরা ইতোমধ্যে কার্যক্রম শুরু
করেছি। প্রযুক্তিনির্ভর অপরাধ বেড়েছে। সাইবার ক্রাইম যেমন বাড়ছে, অন্যদিকে প্রতারণার যেসব ঘটনা ঘটছে, সেগুলোও প্রযুক্তির ব্যবহারে হচ্ছে। এসব অপরাধ দমনে আমাদের সাইবার ইউনিটকে আরও
বেশি শক্তিশালী করা হয়েছে। ডিএমপির ডিবিতে একটি উন্নত প্রযুক্তির আধুনিক ল্যাব স্থাপন করা হয়েছে। ঢাকা নগরীতে অপরাধপ্রবণ যেসব এলাকা রয়েছে সেসব এলাকা সিসিটিভি ক্যামেরার আওতায় আনা হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার কাজ প্রায় শেষ। এখন চিন্তা ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত ও স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার। এ অভিযাত্রায় ডিএমপি ডিজিটাল তথ্যপ্রযুক্তি ও
আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ব্যবহার করে অপরাধ নিয়ন্ত্রণের প্রযুক্তিগত সক্ষমতা অর্জন করছে। সর্বশেষ তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় সহজে ও দ্রুত নাগরিক সেবা নিশ্চিতকরণে প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করছে ডিএমপি।’
এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, পুলিশের মধ্যে আমরা জবাবদিহিতা বৃদ্ধি করতে কাজ করছি। প্রতিটি থানা যাতে মানুষের আশ্রয়স্থল হয়। প্রতিটি পুলিশ যাতে সাধারণ মানুষের বন্ধু হয় সেজন্য আমরা
কাজ করছি। মানুষের চাহিদা অনুযায়ী সেবা দিতে পারাটাই আমাদের প্রধান লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। তবে এর মধ্যেও কিছু ব্যত্যয় আছে। মাঠ পর্যায়ের পুলিশি কার্যক্রমে কিছু সমস্যা হয়। সেগুলো আমরা কমিয়ে আনার চেষ্টা করছি।
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ পুলিশে এই মুহূর্তে দুই লাখ ১২ হাজার পুলিশ সদস্য কাজ করছে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ অনৈতিক কাজ করে। এর দায় পুরো বাহিনী নিবে না। এই জন্য আমরা পুলিশ সদস্যরা কেউ অপরাধ করলে তাকে
সংশোধন করার সুযোগ দেই। তবে গুরুতর অপরাধ করলে আমরা তাদের আইনের আওতায় নিয়ে আসি। তারপর তাদের সাজার ব্যবস্থা করি। কোনো ভাবেই যাতে মানুষ পুলিশ কর্তৃক নির্যাতিত ও নিগৃহিত না হয় সেদিকে লক্ষ
রাখা হচ্ছে। আজকের পুলিশের সঙ্গে ১৫ বছর আগের পুলিশের কোনো মিল পাবেন না। এখন পুলিশ আগের চাইতে অনেক জবাবদিহিতা করে। তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়।