টঙ্গীতে র্যাবের নির্যাতনে নিহত ব্যক্তির নামে থানায় কোনো মামলা তো দূরের কথা বিরূপ কোনো রেকর্ডও পাচ্ছে না পুলিশ। এলাকাবাসীও বলছেন, নিহত আসাদুল ইসলাম আসাদ ভালো মানুষ ছিলেন, নিয়মিত
নামাজ পড়তেন।রোববার রাতে টঙ্গীপূর্ব থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) জাবেদ মাসুদ নয়া দিগন্তকে জানান, নিহত আসাদের বিরুদ্ধে কোনো মামলা আছে কি না তারা খুঁজে দেখছেন, তবে এ পর্যন্ত তারা আসাদের
বিরুদ্ধে মামলাসহ বিরূপ কোনো কিছুই পাননি।শনিবার বিকেলে নিজ গৃহে র্যাবের নির্যাতনে গুরুতর আহত আসাদ ওই দিন রাতেই হাসপাতালে নেয়ার পথে মারা যান। এ নিয়ে এলাকায় ব্যাপক তোলপাড় সৃষ্টি হয়।
গাড়ির গ্যারেজ শ্রমিক আসাদ মুন্সীগঞ্জের টঙ্গীবাড়ি থানার ভাসাইল গ্রামের মৃত আব্দুল হাইয়ের ছেলে। তিনি গাজীপুর মহানগরের টঙ্গী পূর্ব থানাধীন এরশাদনগর ৫ নম্বর ব্লকে পরিবার নিয়ে থাকতেন। তার এ বাসাতেই
মাদকের সন্ধানে শনিবার বিকেলে অভিযান চালায় র্যাব-১ এর সদস্যরা।রোববার দুপুরে নিহতের এরশাদনগরের বাসায় গিয়ে দেখা গেছে, পরিবারের সদস্যদের মাঝে চলছে শোকের মাতম। কেবল সন্দেহের
বশবর্তী হয়ে আসাদকে বিনা দোষে র্যাব সদস্যরা নির্যাতদন চালিয়ে মেরে ফেলেছে বলে অভিযোগ করছেন স্বজনরা।নিহতের স্ত্রী জেসমিন আক্তার জানান, দুপুর দেড়টার দিকে র্যাব পরিচয়ে ৬ থেকে ৭ জন ব্যক্তি
এরশাদনগর ৫ নম্বর ব্লকের কবরস্থান সংলগ্ন তাদের টিনশেড বাড়িতে প্রবেশ করে। মাদক আছে এমন সংবাদের ভিত্তিতে পুরো বাড়িতে তল্লাশি চালায় র্যাব সদস্যরা। কিছুক্ষণ পর র্যাবের পোশাক পরিহিত আরো
একটি দল বাড়িতে প্রবেশ করে। সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত ঘরের ভেতরই আসাদকে পিটিয়ে মাদকের কথিত তথ্য বের করার চেষ্টা চালায় র্যাব সদস্যরা। এসময় বারবার পানি চাইলেও আসাদকে এক ফোঁটা পানি দেননি র্যাব সদস্যরা। আমি আমার স্বামী হত্যার বিচার চাই।নিহতের ছেলে হাফিজুল ইসলাম নিহাদ বলেন, বাবাকে যখন মারধর করা হচ্ছিল তখন আমাকে পাশের রুমে আটকে রাখা হয়। র্যাব সদস্যরা আমাকে মেরে ফেলার ভয় দেখিয়ে বাবার কাছ থেকে তথ্য জানতে চায়। কিন্তু আমার বাবা মাদকের সঙ্গে জড়িত নন মর্মে বরাবরই র্যাব সদস্যদের জানান। র্যাবের সদস্যরা পাশের রুম থেকে আমাকে চিৎকার করতে বলেন বাবা যাতে ভয়ে স্বীকারোক্তি দেন। কিছুক্ষণ পরপরই বাবাকে নির্যাতন চালায় তারা। নির্যাতনের একপর্যায়ে সন্ধ্যা ৬টার দিকে অচেতন অবস্থায় বাবাকে র্যাবের গাড়িতে উঠিয়ে হাসপাতালে নেয়া হয়। পথিমধ্যেই তিনি মারা যান।নিহত আসাদের মা মমতাজ বেগম কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, আমার ছেলের কোনো দোষ নেই। সে সব সময় নামাজ কালাম পালন করতো। আসাদের এক ছেলে এক মেয়ে। দুজনই লেখাপড়া করে। আমার ছেলে কোনো অবৈধ কাজের সাথে জড়িত না। তাকে ফাঁসানো হয়েছে। আমি আল্লাহর কাছে বিচার দিলাম, আল্লাহ যেন তাদের বিচার করেন।নিহতের একমাত্র বোন প্রতিবন্ধী আফিয়া আক্তার লাকি বলেন, আমার ভাই মালিবাগ চৌধুরী পাড়ায় গাড়ির গ্যারেজ চালাতো। এর পর সেখান থেকে গাজীপুর মহানগরের গাছা বড়বাড়ি এসে গ্যারেজ দেয়। করোনার কারণে সেই গ্যারেজটিও বন্ধ হয়ে যায়। বর্তমানে তিনি ছুটা কাজ (যখন যে কাজ পাওয়া যায়) করে বহু কষ্টে সংসার চালাতেন। আমার ভাইকে মাদক কারবারি সন্দেহে ধরার কোনো কারণ নেই। র্যাবের কাছে যদি তেমন তথ্য প্রমাণ থাকতো তাহলে আমার ভাইয়ের একটা হাত বা একটা পা কেটে নিয়ে যেত। তবুতো আমার ভাইকে এক নজর দেখতে পারতাম। সাংবাদিকদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, সহযোগিতা যদি করতে চান তাহলে আমাদের আহাজারির কথা তুলে ধরুন।স্থানীয়রা জানান, আসাদ নিতান্তই ভালো লোক ছিলেন। তবে আসাদের দূর সম্পর্কের এক আত্মীয় বা খালা শ্বাশুড়ি লাইলি মাদক কারবারে জড়িত। লাইলী বেশ কয়েকবার মাদকসহ গ্রেফতার হয়ে জেলে গেছে। তবে লাইলীর সাথে আসাদদের কোনো যোগাযোগ নেই।এদিকে টঙ্গীর আহসান উল্লাহ মাস্টার জেনারেল হাসপাতালে আসাদের লাশ দেখতে এসে নিহতের স্বজন ও এলাকাবাসী বিক্ষোভে ফেটে পড়েন। এ সময় তারা দোষী র্যাব সদস্যদের বিচার দাবি করেন।অপরদিকে ময়নাতদন্ত শেষে লাশ এলাকায় পৌঁছালে নিহতের স্বজন ও স্থানীয়দের মধ্যে শোকের ছায়া নেমে আসে।থানায় র্যাবের দায়েরকৃত মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে এরশাদনগর ৫ নম্বর ব্লকে অভিযানকালে দৌড়ে পালানোর সময় আসাদুল ইসলামকে আটক করা হয়। এসময় তার দেহে তল্লাশি চালিয়ে ৬ শ’ ৩ পিস ইয়াবা ট্যাবলেট উদ্ধার করা হয়। পরে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদে সে জানায় তার বাসায় আরো ৪ হাজার ৪ শ’ পিস ইয়াবা ট্যাবলেট রয়েছে। আসাদুল পালানোর চেষ্টা করলে র্যাব সদস্যদের সাথে ধস্তাধস্তির একপর্যায়ে তার শয়ন কক্ষের খাট ও দেয়ালের সাথে ধাক্কা খেয়ে আহত হয়। পরে শহীদ আহসান উল্লাহ মাস্টার জেনারেল হাসপাতালে নেয়ার কিছুক্ষণ পর কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত বলে ঘোষণা। ধস্তাধস্তিকালে র্যাব সদস্য সরোয়ার হোসেন ও হুমায়ুন কবির আহত হয়ে একই হাসপাতালে চিকিৎসা গ্রহণ করেন।
হাসপাতালের জরুরি বিভাগে দায়িত্বরত চিকিৎসক নুসরাত বলেন, হাসপাতালে আনার পূর্বেই আসাদের মৃত্যু হয়েছে। জরুরি বিভাগে নুসরাতের পালার পরবর্তী দায়িত্বরত চিকিৎসক বদরুন নেছা বলেন, আমি পরে ডিউটিতে এসে হাসপাতালের খাতায় যা লেখা দেখলাম, তাতে বোঝা যাচ্ছে ওই ব্যক্তি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন।
শনিবার রাত ৯টায় হাসপাতালে আসেন র্যাব-১ এর অধিনায়ক (সিও) আব্দুল্লাহ আল মোমেন। এসময় তিনি নিহতের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলেন। পরে উপস্থিত সাংবাদিকদের তিনি বলেন, আসাদ ৬ শ’ পিছ ইয়াবা এক জায়গায় দিয়েছে। তার কাছে আরো মাদক আছে এমন খবরে র্যাব সদস্যরা তার বাড়িতে অভিযান চালায়। পরে সেখানে র্যাব সদস্যদের সঙ্গে তার ধস্তাধস্তি হয়। এসময় দুই র্যাব সদস্যও আহত হন। আহত অবস্থায় আসাদকে হাসপাতালে নেয়ার ২০ মিনিট পর তার মৃত্যু হয়। নিহত আসাদের বিরুদ্ধে পূর্বে কোনো মাদক মামলা আছে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
টঙ্গী পূর্ব থানার ওসি মো: জাবেদ মাসুদ জানান, ময়নাতদন্তের জন্য নিহতের লাশ গাজীপুর শহীদ তাজউদ্দিন আহমেদ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল মর্গে পাঠানো হয়েছে। এ ঘটনায় থানায় একটি অপমৃত্যুর মামলা (নং- ১) রেকর্ড হয়েছে। তিনি আরো জানান, থানায় এ পর্যন্ত রেকর্ডপত্র খুঁজে আসাদের বিরুদ্ধে কোনো মামলা পাওয়া যায়নি।