বিজয়ের বাংলা: বিয়ের এক বছর পর সংসারে অভাব দুর করার জন্য ৩০ বছর আগে কাজের সন্ধানে ভারতে পারি জমান জাহাঙ্গীর আলম ও তার স্ত্রী ফজিলা বেগম। ভারতের রাজধানী চন্ডীগরের হরিয়ানার রেওয়ারী এলাকায়। সেখানে একটি ইটভাটায় কাজের সুযোগ পান এই দম্পতি। সেখানেই দুই ছেলের জন্ম হয়। বড় ছেলে ফারুক ইসলাম ও ছোট ছেলে ফরহাদ হোসেন। বর্তমানে ফারুকের বয়স (২২) ও ফরহাদের বয়স (১৬)। ফরহাদ প্রতিবন্ধী। বড় ছেলে ফারুক ৩ বছর আগে ভারতীয় ১০ হাজার রুপির বিনিময়ে ভারতের কোচবিহার জেলার সাহেবগঞ্জ থানার ধাপড়াহাট এলাকার পাঁচার কারী সদস্য মোজাহার আলীর মাধ্যমে সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশে আসেন।
বর্তমানে ফারক ইসলাম বাংলাদেশের কুড়িগ্রাম জেলার ফুলবাড়ী উপজেলার সদর ইউনিয়নের পূর্বচন্দ্রখানা গ্রামে বাবার ভিটায় বসবাস করছেন। এক বছর আগে ফারুক বিয়ে করে ঘর সংসার করছে। এদিকে চলতি বছরের ২৯ শে আগষ্ট তার বাবা জাহাঙ্গীর আলম, মা ফজিলা বেগম ও ভাই ফরহাদ হোসেন একই পাঁচারকারী সদস্য মোজাহারের মাধ্যমে সীমান্ত অতিক্রম করতে গিয়ে ভারতের কোচবিহার জেলার সাহেবগঞ্জ থানার অধিন ১৯২ ব্যাটালিয়নের সেওটি-২ বিএসএফ ক্যাম্পের সদস্যরা প্রথমে ভাই ফরহাদকে আটক করে।
ফরহাদ প্রতিবন্ধী হওয়ায় আটকের ১২ ঘন্টা পর পতাকা বৈঠকের মাধ্যমে লালমনিরহাট ১৫ বিজিবির অধীন কাশিপুর ক্যাম্পের বিজিবির মাধ্যমে ভাই ফারুক ইসলামের জিম্মায় হস্তান্তর করেন। এর দু’দিন পর একই সীমান্ত দিয়ে ও একই পাঁচারকারী সদস্যের মাধ্যমে বাংলাদেশে প্রবেশের সময় তার বাবা-মাসহ তার নিকট আত্মীয় মুসা মিয়া এবং সুখী বেগমকে আটক করে বিএসএফ।
পরে তাদেরকে অবৈধ অনুপ্রবেশের দায়ে মামলা দিয়ে দিনহাটার জেলখানায় প্রেরণ করেছে সাহেবগঞ্জ থানার পুলিশ। বিষয়টি জানতে পেরে জাহাঙ্গীর আলমের ছেলে ফারুক ইসলাম তার বাবা-মাসহ ওই নিকট আত্মীয়দের মুক্তি চেয়ে গত মাসের ৩০ সেপ্টেম্বর ফুলবাড়ী উপজেলা নির্বাহী অফিসারের বরাবরে লিখিত আবেদন করেন।
অন্য দিকে ভারতে থাকা বাংলাদেশিরা নিজ দেশে ফেরত আসার জন্য কোচবিহার জেলার সাহেবগঞ্জ থানার সীমান্তবর্তী খারুবাজ এলাকায় পাঁচারকারী সদস্য আমিনুল ইসলাম মন্ডলের বাড়ীতে নিয়ে আসেন। তার বাড়িতে কয়েকদিন অবস্থান করে ওই বাংলাদেশিরা। প্রতিটি বাংলাদেশি সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে ঢোকার জন্য জনপ্রতি ১০ হাজার টাকা চুক্তি হয়।
গত ৪ জুলাই ভোর ৬ টার দিকে বাংলাদেশিদের সীমান্ত অতিক্রম করার প্রস্তুত্তি নেওয়ার সময় ভারতীয় ১২৯ ব্যাটালিয়নের অধীন সাহেবগঞ্জ ক্যাম্পের বিএসএফের সম্মিলিত বাহিনীর সদস্যরা দালাল আমিনুল ইসলামের বাড়ী থেকে তাদের আটক করে সাহেবগঞ্জ থানায় সোপর্দ করে। সাহেবগঞ্জ থানা পুলিশ একই পরিবারের ৮ বাংলাদেশিদের বিরুদ্ধে অবৈধ অনুপ্রবেশের দায়ে মামলা দায়ের করে তাদেরকে দিনহাটা কারাগারে পাঠিয়ে দেয়।
কারাগারে থাকা বাংলাদেশিরা হলেন, ফুলবাড়ী সদর ইউনিয়নের সাবেক ছিটমহলের সমন্বয়পাড়া এলাকার মৃত সোনা মিয়ার ছেলে সিরাজুল ইসলাম (৫০) ও তার স্ত্রী শেফালী বেগম (৪৫), ভাই নজরুল ইসলাম (৫৫), ছেলে নুরনবী মিয়া (২৮), পুত্রবধূ (নুরনবীর স্ত্রী) হাবিবা বেগম (২৫) নাতি (নুরনবীর ছেলে) শাকিবুল হাসান (০৬), নাতনি (নুরনবীর মেয়ে) নুরনাহার খাতুন (০৫)। বড় ছেলে নুর আলমের স্ত্রী সেলিনা বেগম (১৯)তাদের মধ্যে তিন পুরুষ দিনহাটা কারাগারে এবং তিন নারী ও এক শিশু কোচবিহার কারাগারে আছেন। সিরাজুল ইসলামের ভাতিজা আশরাফুল আলম তার চাচা-চাচিসহ একই পরিবারের ৮ বাংলাদদেশিকে ভারতের জেল থেকে মুক্তি পেতে চলতি বছরের ১১ জুলাই কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসক বরাবরে আবেদন করেছেন।
এ ছাড়াও অবৈধ অনুপ্রবেশের দায়ে সাবেক দাসিয়ারছড়া কালিহাট এলাকার রতন মিয়া (৩২), মেয়ে রিয়া মনি (০৪),কাশিপুর এলাকার আছিয়া বেগম (৩২)সহ ফুলবাড়ী উপজেলা আরও অন্তত শতাধিক বাংলাদেশি নাগরিক ভারতের কারাগারে বন্ধী থাকায় তাদের স্বজনরা মুক্তির জন্য দুই দেশের সরকারের হস্তক্ষেপ কামনা করছেন। কারাগারে থাকা বাংলাদেশিরা জীবন জীবিকার সন্ধানে সীমান্ত পেড়িয়ে ভারতে গিয়ে হরিয়ানা রাজ্যের রেওয়ারি জেলার নাহারলাখি গ্রামের ইট ভাটায় র্দীঘদিন ধরে পরিবার-পরিজন নিয়ে কাজ করতেন।
জাহাঙ্গীর আলমের ছেলে ফারুক ইসলাম তার বাবা-মাকে দ্রুত মুক্তি জন্য দুই দেশের সরকারে কাছে জোড়দাবী জানান।
জাহাঙ্গী আলমের মা জোহরা বেগম (৯০) কান্নাজড়িত কন্ঠে জানান, বাহে অভাবের কারণে মোর ছাঁওয়াটা ৩০ বছর আগে নতুন বৌকে নিয়ে ভারতের ইটভাটায় কাজোত (কাজে) গেইচে (যান)। ভারতের ইটভাটায় দুইটা নাতির জন্ম। নাতি দুইটা এখন বাড়ীত আছে। মোর ছাঁওয়া (ছেলে) ও ছাঁওয়ার বৌ বাংলাদেশ আসার সময় ভারতে পুলিশ জেলোত দিছে। বাহে ছেলের জন্য মনটা কাঁদে। বাহে মুই খুবেই অসুস্থ। কখন যে মরং। মরণের আগে অনন্ত ছেলেটাক শেষ বারের মতো দেখি মরবার চাং বাহে ! ছেলে জাহাঙ্গীর ও ছেলের বৌ ফজিলা বেগমের মুক্তি চেয়ে সরকারের কাছে নব্বই বছরের মা জোহরা বেওয়ার এই আকুতি।
সিরাজুল ইসলামের ভাতিজা আশরাফুল আলম জানান, আটক ব্যক্তিদের জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে দ্রুত মুক্তির জন্য সরকারের সু-সৃষ্টি কামনা করছি। ছিটমহল আন্দোলনের সাবেক নেতা আলতাফ হোসেন জানান, ভারতে আটক ব্যক্তিরা সবাই বাংলাদেশের নাগরিক। সাবেক ছিটমহলের যারা বাসিন্দা তারা বাংলাদেশ সরকারের ২০১৬ সালের গেজেটভুক্ত। দাসিয়ারছড়া সমন্বয়পাড়া এলাকার একই পরিবারের ৮ বাংলাদেশিসহ ফুলবাড়ী উপজেলার প্রায় শতাধিক বাংলাদেশির মুক্তির জন্য বাংলাদেশ সরকারের হস্তক্ষেপ কামনা করছি।
ফুলবাড়ী সদর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান হারুন-অর-রশিদ জানান, সাবেক ছিটমহলসহ চন্দ্রখানা এলাকার বেশ কিছু বাংলাদেশি ভারতের বিভিন্ন জায়গায় কাজ শেষে বাংলাদেশে প্রবেশের সময় ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনী (বিএসএফ) সদস্যরা তাদেরকে আটক করে। তারা বর্তমানে ভারতের কারাগারে বন্ধী। আমরা তাদের মুক্তির জন্য বাংলাদেশ সরকারের সু-দৃষ্টি কামনা করছি।
এ বিষয়ে উপজেলা নির্বহিী অফিসার (ইউএনও) সুমন দাস আবেদন পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করে জানান, ভারতের কারাগারে থাকা বাংলাদেশিদের বিষয়ে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও পুলিশ প্রশাসনের মাধ্যমে তদন্ত করে, তদন্ত প্রতিবেদন জেলা প্রশাসক মহাদয়ের কাছে পাঠানো হবে। জেলা প্রশাসক তাদের দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করবেন।