ওই নারীর স্বামী বলেন, ‘ঘটনার পরদিন বিকেলে মামলা দায়েরের আগে কক্সবাজার থানার বাইরে চায়ের দোকানের সামনে সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে এক ব্যক্তি আমাকে একটি চিরকুট দেয়। ওই চিরকুটের লেখা অনুযায়ী আমাকে কাজ করতে বলেছিল সে।’কক্সবাজারে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের
অভিযোগ তোলা নারীর স্বামী দাবি করেছেন, একটি উড়ো চিঠিতে হুমকি পেয়ে তার স্ত্রী আদালতে ‘মিথ্যা’ জবানবন্দি দিয়েছেন। কক্সবাজার থেকে সোমবার সকালে ঢাকায় ফিরে নিউজবাংলার কাছে এমন দাবি করেন তিনি।ওই নারী গত শুক্রবার কক্সবাজারের জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম
হামীমুন তানজীনের আদালতে জবানবন্দি দেন। জবানবন্দিতে তিনি যে বিবরণ দিয়েছেন তাতে সৈকত এলাকা থেকে তাকে অপহরণের বিষয়টি নেই। ওই নারী আদালতকে জানান, তাকে শহরের সি টাউন হোটেলের সামনে থেকে অপহরণ করা হয়।তবে ঢাকায় ফেরার পর ওই নারীর
স্বামী নিউজবাংলার কাছে দাবি করেন, একটি উড়ো চিঠিতে হুমকি পাওয়ার কারণেই তার স্ত্রী সৈকতের লাবনী পয়েন্ট থেকে অপহরণের বিষয়টি আদালতে চেপে যান।ওই নারীর স্বামী অবশ্য বলছেন, মামলার প্রধান আসামি আশিকুল ইসলামের বাহিনী কেবল তার স্ত্রীকে অপহরণ করেছিল।
তিনি ও তাদের সন্তানকে জিম্মির কোনো ঘটনা ঘটেনি। ওই নারী ও স্বামীর সঙ্গে পুরো কথোপকথনের রেকর্ড রয়েছে নিউজবাংলার কাছে।‘সংঘবদ্ধ ধর্ষণের’ অভিযোগে বৃহস্পতিবার রাতে ওই নারীর স্বামী চারজনের নাম উল্লেখ ও তিনজনকে অজ্ঞাত আসামি করে কক্সবাজার
সদর মডেল থানায় মামলা করেন।মামলায় নাম উল্লেখ করা চার আসামি হলেন কক্সবাজার শহরের মধ্যম বাহারছড়া এলাকার আশিকুল ইসলাম, মোহাম্মদ শফি ওরফে ইসরাফিল হুদা জয় ওরফে জয়া, মেহেদী হাসান বাবু ও জিয়া গেস্ট ইন হোটেলের ম্যানেজার রিয়াজ উদ্দিন ছোটন।পুলিশ বলছে, অভিযুক্ত আশিকের বিরুদ্ধে নারী ও শিশু নির্যাতন, ছিনতাই, ইয়াবা ব্যবসাসহ বিভিন্ন অভিযোগে ১৬টি মামলা আছে। তার অন্যতম সহযোগী জয়ার বিরুদ্ধেও দুটি মামলা আছে। তারা মূলত কক্সবাজারের হোটেল-মোটেল জোনের ত্রাস হিসেবে পরিচিত। তাদের গ্যাংয়ে অর্ধশতাধিক সদস্য রয়েছেন। তারা গ্রেপ্তারও হয়েছেন একাধিকবার।মামলার প্রধান আসামী রোববার মাদারীপুর থেকে গ্রেপ্তার করে র্যাব।
এছাড়া, এজাহারভুক্ত আরও চার জনকে গ্রেপ্তার করেছে কক্সবাজার পুলিশ।ওই নারীর স্বামী সোমবার নিউজবাংলাকে বলেন, তারা সেপ্টেম্বর মাস থেকে টানা কক্সবাজারে ছিলেন। এর আগেও বিভিন্ন সময়ে সেখানে গিয়েছেন।তার দাবি, ‘ধর্ষণের ঘটনা’র একদিন আগে কক্সবাজারের একটি হোটেলে তাদের সঙ্গে আশিকের পরিচয় হয়। প্রথম দেখায় আশিক তাদের আর্থিক সহায়তা দিলেও পরে চাঁদা দাবি করেন। আর সেই টাকার জন্যই স্ত্রীকে অপহরণের পর ধর্ষণ করা হয়।ওই নারীর স্বামী দাবি করেন, জীবিকার তাগিদে গেল তিন মাস ধরে পরিবার নিয়ে তিনি কক্সবাজারের বিভিন্ন হোটেলে রুম ভাড়া করে থাকছিলেন। গত ২১ ডিসেম্বর তারা অবস্থান করছিলেন লাইট হাউজ এলাকার একটি হোটেলে।
সেদিন রাতে আশিক হঠাৎ করে ওই দম্পতির হোটেল রুমে ঢুকে পড়েন। আর তখনই তাদের সঙ্গে আশিকের পরিচয় হয়।ওই নারীর স্বামী নিউজবাংলাকে বলেন, ‘অনুমতি নিয়ে রুমে ঢুকে পড়ায় আশিকের সঙ্গে আমার স্ত্রীর বাগবিতণ্ডা হয়। পরে আশিকের প্রভাব টের পেয়ে আমরা তার কাছে ক্ষমা চাই এবং সন্তানের অসুস্থতার কথা খুলে বলি। এতে আশিক সহানুভূতি দেখিয়ে বাচ্চার চিকিৎসার জন্য জন্য এক হাজার টাকা দিয়ে যান।’তবে আশিকের সঙ্গে ঝামেলায় জড়ানোর কারণে ওই হোটেলের ম্যানেজার তাদের হোটেল ছেড়ে দিতে বলেন বলে দাবি করেন ওই নারীর স্বামী।পরদিন সকালে তারা সি ল্যান্ড নামের আরেকটি হোটেলে ওঠেন।ওই নারীর স্বামীর ভাষ্য, ‘২২ ডিসেম্বর বিকেলে স্ত্রী-সন্তানকে নিয়ে লাবনী বিচে ঘুরতে যাই। সেখানে হঠাৎ আশিকের সঙ্গে আমার ধাক্কা লাগে। তখন আশিক অনেকটা গায়ে পড়ে আমার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করে।’আশিক এরপর ‘নিজেদের খরচের জন্য’ কিছু টাকা দাবি করেন বলে জানান ওই নারীর স্বামী। তার দাবি, কিছুদিন পর এই টাকা দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে তিনি স্ত্রী সন্তানকে নিয়ে হোটেলে ফিরতে রওনা দেন। তবে কিছুদূর যাওয়ার পর তার স্ত্রী আচার কিনতে দাঁড়ালে তিনি সামনে
এগিয়ে যান। কিছুক্ষণ পর পেছনে ফিরে দেখেন স্ত্রী নেই।ওই নারী নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আচারের ভ্যানের সামনে দাঁড়ানো অবস্থায় আশিক হঠাৎ তার হাত ধরে টান দিয়ে একটি সিএনজি অটোরিকশায় তুলে নেয়। তখন আশিকের সঙ্গে আরও দুজন ছিল। সিএনজিতে বসেই আশিক আমার স্বামীকে ফোন করে ৫০ হাজার টাকা নিয়ে আসতে বলে।’ওই নারীর দাবি, অটোরিকশায় তুলে আশিক প্রায় এক ঘণ্টা কক্সবাজারের বিভিন্ন সড়কে ঘুরে বেড়ায়। এরপর তাকে একটি এক তলা বাসায় নিয়ে যাওয়া হয়।ওই নারী বলেন, ‘বাসাটি তালা দেয়া থাকায় আশিক ছোটন নামের এক জনকে (জিয়া গেস্ট ইন হোটেলের ম্যানেজার) ফোন করে তার মোটরসাইকেল নিয়ে আসতে বলে। এরপর সেই মোটরসাইকেলের পিছনে চড়িয়ে ওই নারীকে একটি ঝুপড়ি চায়ের দোকানে নিয়ে যাওয়া হয়।ওই নারীর অভিযোগ, ঝুপড়ি চায়ের দোকানের পেছনের কক্ষে নিয়ে আশিকের দুই বন্ধু তাকে ধর্ষণ করেন। এর কিছুক্ষণ পর আশিক এসে নারীকে আবার মোটরসাইকেলে করে জিয়া গেস্ট ইন হোটেলে নিয়ে যান।ওই নারী বলেন, ‘হোটেলে ঢোকার আগে আশিক আমাকে হুমকি দিয়ে বলে আমার স্বামী-সন্তানকে আটকে রাখা হয়েছে। কোনো ঝামেলা করলে তাদের মেরে ফেলা হবে।’এরপর আশিকের সঙ্গে নিজের ছদ্মনামে হোটেলের লগ বইয়ে এন্ট্রি করেন ওই নারী। এরপর একটি রুমে গিয়ে আশিক ইয়াবা সেবন করে তাকে ধর্ষণ করেন বলে জানান ওই নারী।তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এরপর আমার স্বামী আশিককে ফোন করে জানান তিনি টাকা দেবেন, তবে স্ত্রীকে ছেড়ে দিতে হবে।’ওই নারীর স্বামী নিউজবাংলার কাছে দাবি করেন, বিচ এলাকায় স্ত্রীকে দেখতে না পেয়ে শুরুতে তিনি ৯৯৯-এ ফোন করেন। তবে সে সময় তিনি, স্ত্রীকে অপহরণের কোনো তথ্য দেননি। স্ত্রীকে না পাওয়ার বিষয়টি কক্সবাজার সদর থানায় জানানোর পর থানা থেকে তাকে জিডি করার পরামর্শ দেয়া হয়। এরপর একটি বিলবোর্ড থেকে তিনি র্যাবের নম্বর পেয়ে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করলে অল্প সময়ের মধ্যেই তাদের টিম ঘটনাস্থলে পৌঁছায়। র্যাবের পরামর্শেই তিনি আশিকের ফোনে যোগাযোগ করে টাকা দেয়ার প্রস্তাব করেন।ওই নারী নিউজবাংলাকে জানান, তার স্বামী আশিককে ফোন করার কিছু সময়ের মধ্যে আরেক জন ফোন করেন। তিনি আশিককে বলেন, ডিবি পুলিশ তাকে খুঁজছে। এরপরই হোটেল ছেড়ে চলে যান আশিক।পরে ওই নারী হোটেল থেকে বেরিয়ে কিছুটা দূরে স্বামীসহ র্যাব সদস্যদের দেখতে পান।‘উড়ো চিঠিতে হুমকি’ওই নারীর স্বামী দাবি করেন, র্যাব সদস্যরা তাদের কক্সবাজার সদর থানায় হস্তান্তর করেন। ২৩ ডিসেম্বর সদর থানায় থাকার সময়ে তামোবাইল ফোনে এক সাংবাদিক ফোন করেন।
বিকেলে থানার বাইরে ওই সাংবাদিকের সঙ্গে দেখা হয় ওই নারীর স্বামীর। তবে তার নাম বা আর কোনো পরিচয় তিনি জানেন না বলে নিউজবাংলার কাছে দাবি করেছেন।ওই নারীর স্বামী বলেন, ‘ঘটনার পরদিন বিকেলে মামলা দায়েরের আগে কক্সবাজার থানার বাইরে চায়ের দোকানের সামনে সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে এক ব্যক্তি আমাকে একটি চিরকুট দেয়। ওই চিরকুটের লেখা অনুযায়ী আমাকে কাজ করতে বলেছিল
কথিত সেই চিরকুটের একটি নমুনা পেয়েছে নিউজবাংলা। একটি এ ফোর সাইজের সাদা কাগজে কম্পিউটার কম্পোজে এতে লেখা আছে:
‘তারিখ: ২৩-১২-২০২১ ইং, বিকাল: ০৪.০০ ঘটিকা।
আমি যা বলতেছি তোরা তাই করবি। তাহলে তোদের মঙ্গল হবে। কারণ তোরা জানিস আমি কে? পুলিশ প্রশাসনও জানে আমার কথা। আমার নামে কত মামলা আছে তা আমি নিজেও জানি না। তুই তোর ব্যবসায়ের কথা বলবি না। তুই বলবি আমি তোর বউকে সি টাউন হোটেলের সামনে থেকে নিয়ে গিয়েছি এবং তোর বউ দেহব্যবসা করে। যদি না বলিস তাহলে আমি তোকে কক্সবাজার থেকে যেতে দিব না। আর বাকিটুকু বললাম না, তুই গুছিয়ে বলিস আর আমার চিঠির ব্যাপারে যেন কেউ না জানে।’
ওই নারীর স্বামীর দাবি, এই চিঠিতে ঘাবড়ে গিয়ে তিনি স্ত্রীকে মিথ্যা জবানবন্দি দিতে রাজি করান। সে অনুযায়ী, তার স্ত্রী আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন।
রাজমিস্ত্রী থেকে কক্সবাজারে হোটেলের ‘দালাল’
ওই নারীর স্বামী জানান, তিনি এক সময়ে রাজমিস্ত্রীর কাজ করতেন। রাজধানীর বনশ্রীর একটি কাজী অফিসে তিনি ওই নারীকে বিয়ে করেন গত বছরের ২৩ জুলাই। তবে স্ত্রী অপ্রাপ্তবয়স্ক হওয়ায় সেই বিয়ের রেজিস্ট্রি এখনও হয়নি।
ওই নারীর স্বামীর ভাষ্য অনুযায়ী, বিয়ের পর তারা প্রায় ছয় মাস নারায়ণগঞ্জের একটি পৌরসভায় ছিলেন। বিয়ের পরপরই তার স্ত্রী গর্ভবতী হন। এরপর তারা চলে আসেন ঢাকার যাত্রাবাড়ীতে।
সেখানে থাকা অবস্থায় গত ৮ জানুয়ারী তারা কক্সবাজারে বেড়াতে যান। সেই ট্যুরে আরও তিন বন্ধু ও তাদের স্ত্রীরাও গিয়েছিলেন। তবে সেদিন রাতেই তাদের হোটেলে পুলিশের অভিযানে তার স্ত্রীসহ দলের ছয় জন গ্রেপ্তার হন। তখন হোটেলের বাইরে থাকায় আটক হননি তিনি ও তার এক বন্ধু।
সে সময় তার স্ত্রী সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন বলেও জানান তিনি। এরপর ১২ দিন জেলে থাকার পর তার জামিনে ছাড়া পান।
ওই নারীর স্বামী বলেন, গত এপ্রিলে রাজধানীর একটি ক্লিনিকে তাদের সন্তান জন্ম নেয়। তবে কয়েক মাস পর সন্তানের হৃদযন্ত্রে ফুটো ধরা পড়ে। এরপর আয় রোজগার বাড়াতে সাগর নামের এক বন্ধুর সঙ্গে গত সেপ্টেম্বরে তারা আবার কক্সবাজারে যান।
ওই নারীর স্বামীর ভাষ্য, সাগর কক্সবাজারের হোটেলগুলোর ‘দালাল’ হিসেবে কাজ করেন। এই কাজে তিনিও জড়িয়ে পড়েন।
হুমকির বিষয়ে কী বলছে পুলিশ
চিরকুটের মাধ্যমে হুমকির বিষয়টি জানতে চাইলে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও কক্সবাজার ট্যুরিস্ট পুলিশ পরিদর্শক মো. রুহুল আমিন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এ ধরনের কোন হুমকি বা চিরকুটের কথা ভুক্তভোগী ও তার স্বামী আমাদের কাউকেই বলেননি। তার সঙ্গে যে অন্যায় হয়েছে তার বিচারের জন্য আমরা যথাসাধ্য কাজ করে যাচ্ছি। তারা ঢাকায় যাওয়ার আগেও আমাকে বিষয়টি জানাতে পারতেন, কারণ আমি সব সময় তাদের খোঁজ খবর রাখছি।’
মিথ্যা জবানবন্দির বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন করলে তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আদালত জবানবন্দি নিয়েছেন বলে আমি ঠিক বলতে পারব না যে, নতুন করে আর জবানবন্দি গ্রহণ হবে কিনা। তবে তারা আমাকে বিষয়টি জানালে অবশ্যই তদন্ত করে দেখব।’